ডাঃ গুণের নতুন লেখাপত্র সংকলিত হচ্ছে এই অংশে। কখনও প্রবন্ধ, কখনও স্মৃতিচারণ, কখনও অন্য কোনও প্রতিবেদন। নতুন অডিও-ভিডিও বা স্থিরচিত্রও পাবেন এই অংশে।
অনেক বছর আগে ফেসবুকে পোস্ট করা দুটো ছবি বছর বছর ফেসবুক মেমারিতে ঘুরে ফিরে আসে।
একটা ছবি কোন এক চা বাগানে সেন্ড জন্স অ্যাম্বুলেন্সের একটি বাহনের সামনে আমরা কয়েকজন।
আরেকটি মাথাভাঙ্গার এক সরকারি অতিথিশালার সামনে বি ডি ও- র সঙ্গে আমরা।
৪০ বছর আগে ১৯৮৪ র মে মাসে আমরা গিয়েছিলাম কুচবিহারে এক মহামারীর সঙ্গে লড়াই করতে।
তার কয়েক মাস আগে আমরা, তখনকার পশ্চিমবঙ্গের সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোর জুনিয়র ডাক্তাররা, সরকারের সঙ্গে এক অসম লড়াই লড়ে জিতেছি। আমাদের স্লোগান "স্বাস্থ্য কোন ভিক্ষা নয়, স্বাস্থ্য আমার অধিকার" মানুষের সমর্থন পেয়েছে। ১৯৮৪-র এপ্রিল মাসে পশ্চিমবঙ্গের ১১ টি জেলা যখন রক্ত আমাশার এক মহামারিতে আক্রান্ত, তখন আমরা অনুভব করলাম আমাদের মানুষের পাশে দাঁড়ানো উচিত।
মেডিকেল কলেজের এনসিসি রুমে বোধ হয় মিটিংটা হয়েছিল। অল বেঙ্গল জুনিয়র ডাক্তার ফেডারেশনের প্রতিনিধিরা ছাড়াও ছিলেন মেডিকেল কলেজ ও আরজিকর মেডিকেল কলেজ ছাত্র সংসদের প্রতিনিধিরা, কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার প্রতিনিধিরা--মিটিং এর মিনিটসে দেখছি মোট ৫৬ জন ছিলাম। মিনিটসে তারিখ লিখতে ভুল হয়ে গেছিল।
সারা বাংলা জুনিয়র ডাক্তার ফেডারেশন (ABJDF)-এর নেতৃত্বে মেডিকেল কলেজ ছাত্র সংসদ, আর জি কর মেডিকেল কলেজ ছাত্র সংসদ, ক্যালকাটা ন্যাশনাল ওয়েলফেয়ার অর্গানাইজেশন, পিপলস হেলথ সার্ভিসেস অ্যাসোসিয়েশন ও দ্বারকানাথ কোটনিশ মেমোরিয়াল কমিটির যৌথ উদ্যোগে তৈরি হয়েছিল ‘আন্ত্রিক মহামারী প্রতিরোধ কমিটি’।
এরপর চিকিৎসা ত্রাণের জন্য সামগ্রী জোগাড় করা। বাগরি মার্কেট থেকে ওষুধ, গ্লুকোজ, সোডিয়াম ক্লোরাইড, পটাশিয়াম ক্লোরাইড ও সোডিয়াম বাই কার্বনেট কেনা। দাঁড়িপাল্লায় ওজন করে প্লাস্টিকের প্যাকেটে ভরা। আমাদের তৈরি প্যাকেটের ওআরএস।
টিকিট ছাড়াই উত্তরবঙ্গগামী দূরপাল্লার ট্রেনের অ্যান রিজার্ভড কম্পার্টমেন্টে চড়ে বসলাম। সংখ্যায় বেশি ছিলাম তাই বসার জায়গাও জোগাড় হয়ে গেল। আমি মনে আছে সিটের নিচে খবরের কাগজ পেতে রাতে ঘুমিয়ে ছিলাম। সিট দখলের জন্য একদল কম বয়সী ছেলের সঙ্গে ঝগড়া হয়েছিল। গন্তব্যে পৌঁছে ট্রেন থেকে নেমে তারা জানলার দিকে কোলড্রিংসের বোতল ছুড়ে মারল। জানলার পাশে বসেছিল উৎপল, উৎপল জানা। ওর উপরের পার্টির মাঝর দুটো দাঁত উপরে ছিটকে গেল।
১৯ জন জুনিয়ার ডাক্তার এবং মেডিকেল ছাত্র কুচবিহারে পৌঁছায় ৩রা মে।
২রা মে ১৯৮৪ তারিখে সই করা আরজি কর মেডিকেল কলেজ স্টুডেন্ট ইউনিয়নের সোশাল সার্ভিস সেক্রেটারি উজ্জ্বল মিশ্রের একটা চিঠি পাচ্ছি, দেখা যাচ্ছে অরিজি কর মেডিকেল কলেজ থেকে চিকিৎসা দলে ছিলেন আটজন—ডা উৎপল জানা, ডা রূপম কর্মকার, ডা স্মরজিত ঘোষাল, অনিরুদ্ধ মুখার্জী, গৌতম দাস, প্রকাশ সানকি, দেবতোষ সাহা এবং বিদ্যুৎ সাহা।
এ বি জে ডি এফ এর তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ডাক্তার পার্থ ত্রিপাঠীর প্রতিবেদন থেকে দেখা যাচ্ছে ১৯ জনের মধ্যে ১০ জন সরকারি স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলিতে কাজ করে। আমার আর্কাইভে কুচবিহার জেলার সি এম ও এইচ এর সই করা একটা অর্ডার পাচ্ছি, তারিখ ৪ঠা মে, ১৯৮৪। আদেশ করা হয়েছে ডা রূপম কর্মকার এবং গৌতম দাস যোগ দেবে পুন্ডিবাড়ি প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে, ডা সজল কুন্ডু এবং তুষার মন্ডল যোগ দেবেন দিনহাটা মহকুমা হাসপাতালে, সুকুমার মিত্র ও ব্রহ্মানন্দ ঘোষ বামনহাট প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে, অনিরুদ্ধ মুখার্জি ও দেবতোষ সাহা জামালদহ উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্রে, ডা উৎপল জানা, তাপস সাহা, স্বরূপ মন্ডল এবং শ্যামল মিত্র জলপাইগুড়ির ফালাকাটায়। অবশ্য সজল এবং তুষার শেষ অবধি সেন্ট জন্স অ্যাম্বুলেন্সের টিমে ছিল।
সেন্ট জন্স অ্যাম্বুলেন্সের কুচবিহার জেলা শাখার সঙ্গে কাজ করে ডা সজল কুন্ডু, ডা পুণ্যব্রত গুণ, তুষার মন্ডল, অনিরুদ্ধ কীর্তনীয়া এবং অমিয় বেরা ৫ই মে থেকে ১১ই মে অব্দি।
ডা পার্থ ত্রিপাঠীর নেতৃত্বে মোট ৪জন কুচবিহার শহরকে কেন্দ্র করে নর্থ বেঙ্গল স্টেট ট্রান্সপোর্ট কারিগরি শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের অফিস, আই এম এ ক্লিনিক এবং শহরের পার্শ্ববর্তী গ্রামীণ ও আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় চিকিৎসার কাজ করে।
মোট ১২২১জন আন্ত্রিক রোগীর চিকিৎসা করে এবিজেডিএফ-এর চিকিৎসা দলগুলি।
যারা সরকারি স্বাস্থ্য কেন্দ্রে গিয়েছিল তাদের অভিজ্ঞতা হল যে কেবল কিছু ডাক্তার বা ডাক্তারি ছাত্রকে পাঠিয়েই কর্তৃপক্ষ দায়িত্ব শেষ করে দিয়েছে। তাদের কাজের সুযোগ করে দেওয়া হয়নি। অনেক ক্ষেত্রেই থাকা খাওয়ার ব্যবস্থাও নিজেদের করতে হয়েছে। প্রয়োজনীয় ওষুধ যথেষ্ট পরিমাণে ছিল না। ঘোক্সাডাঙ্গা এবং পুন্ডিবাড়ীতে আমাদের যে দুজন গেছিল তাদেরকে মেডিকেল অফিসার ফেরত পাঠিয়ে দিতে বাধ্য হন। অন্যদের মূলত আউটডোরে নিয়মিত সাধারণ রোগী দেখা এবং ইনডোরে ভর্তি সাধারণ রোগীদের চিকিৎসা করতে হয়।
আমরা যারা সেন্ট জন্স অ্যাম্বুলেন্সের সঙ্গে কাজ করেছিলাম, তারা অপেক্ষাকৃত বেশি কাজে সুযোগ পাই। যদিও আমাদের শাসকদলের পক্ষ থেকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করার একটা প্রচেষ্টা ছিল তবুও আমরা স্বাধীনভাবে কাজ চালিয়ে যাই এবং জনসাধারণের মধ্যে প্রচার চালাতে পারি।
তৃতীয় যে টিমটি সম্পূর্ণ স্বাধীন ভাবে কাজ করেছিল তাদের সহায়তা করে অল বেঙ্গল স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশন, নর্থ বেঙ্গল স্টেট ট্রান্সপোর্ট কারিগরি শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন, সুশ্রুত সেবা সংস্থা, আই এম এ, এইচ এস এ এবং ব্যক্তিগতভাবে কর্মচারী নেতা বিনয় ব্যানার্জি। তারা রোগের চিকিৎসা করার পাশাপাশি রোগ প্রতিরোধের জন্য সামাজিক সমস্যা সমাধানের বিষয়ে প্রচার করে।
যেসব জায়গায় আমরা কাজ করি সেখানে ক্ষমতায় আসীন দলগুলির বিরুদ্ধে দলবাজির অভিযোগ শোনা যায়। সরকারি প্রাণে প্রধানত কিছু ডাক্তার এবং ওষুধপত্র পাঠানোর উপরই জোর দেওয়া হয়।। রোগ যখন ছড়িয়েছে তখন যথেষ্ট ওষুধ ছিল না। বেসিলারি ডিসেন্ট্রি চিকিৎসার জন্য সেই সময় কার্যকর ছিল ন্যালিডিক্সিক এসিড অথচ চিকিৎসা করা হয়েছে এন্টেরোকুইনল এবং সালফাগুয়ানিডিন দিয়ে। মানুষকে সচেতন করার বিষয়টা ছিল অবহেলিত। অর্থের অপচয় এবং পরিকল্পনার অভাব সর্বত্র লক্ষ্য করা যায়।
কতগুলো ধারণা নিয়ে আমরা কুচবিহারে গেছিলাম। সেই ধারণা আরও দৃঢ়মূল হয়। আমরা বুঝি কেবল সালমোনেলা নয়, পানীয় জলের অভাব নয়, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, অপুষ্টি, দারিদ্র স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অপ্রতুলতা—এই সবই মহামারীর কারণ।। আমরা বুঝি আন্ত্রিক মহামারীকে প্রতিরোধ করতে গেলে মানুষের জীবনযাত্রার আমূল পরিবর্তন চাই।